Mohammad Arif . ০৪/০৮/২০২৩ 11:24 PM
ড. মো. ইকবাল হোছাইন
আরবদের বাজার আর বেশিদিন সেবাশ্রমনির্ভর থাকবে না। সেবাশ্রম থেকে তা সৃজনশীল শ্রমবাজার বা টেকনো শ্রমবাজারের দিকে যাচ্ছে। এ বাজারকে নিজেদের করায়ত্ত রাখতে ধর্মীয় ও সামাজিক অর্থনীতির সমন্বিত প্রচেষ্টা যেমন নিতে হবে, তেমনি সরকারকেও আরব দেশগুলোর শুধু শ্রমবাজারই নয়, শিক্ষা-চিকিৎসা, টেকনো ও ধর্মীয় অর্থনীতির বাজার ধরার ব্যাপক পরিকল্পনা নিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিলাম ক্লিবল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনের পরিচালক কার্টি ফারমেনের সঙ্গে। কালো স্যুট-টাই পরা ক্যাথলিক খ্রিস্টান মধ্যবয়সী স্মার্ট মহিলা কার্টির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, তিনি আরব সংস্কৃতি ও সাহিত্য সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। আরবদের সম্পর্কে জানার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠলেন, কী বলেন, আরবি ভাষার দখল এখানে জব মার্কেটের বাড়তি আকর্ষণ কি সরকারি চাকরি অথবা করপোরেশন। আমার বড় ছেলে গ্র্যাজুয়েশনের পর আরবি শেখার জন্য দোহায় ৬ মাস থেকেছে। দেখছেন না আমার মাথায় স্কার্ফ। এটা আমার ছেলের পছন্দেই এখন নিয়মিত পরিধান করি। চাকরিপ্রার্থী আমেরিকানদের কাছে আরবি শুধু মুসলমানদের ভাষা নয়, উন্নত জীবনের হাতছানিও বটে। ১৮ ডিসেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস। জাতিসংঘের ছয়টি ভাষার অন্যতম আরবি ভাষাকে ইউনেস্কো ২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আরবি পৃথিবীর পঞ্চম শক্তিশালী ভাষা। শুধু স্পিকিং জনসংখ্যার ওপরই ভাষার গুরুত্ব নির্ধারিত হয় না, বরং কেপিআইর (দ্য পাওয়ার ল্যাংগুয়েজ ইনডেক্স) নির্ধারিত ২০টি সূচকের মাধ্যমে বিশ্বের শক্তিশালী বা গুরুত্বপূর্ণ ভাষার সূচক নির্ধারিত হয়। সূচকের অন্যতম দিকগুলো হচ্ছে, ভাষায় কথা বলা জনসংখ্যা, জিডিপি, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, কূটনীতি, ট্যুরিজম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও হেরিটেজ। মূলত এসব দিক থেকে আরবি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ভাষা। প্রাচীনপন্থী ট্র্যাডিশনাল আরবির মোড়ক থেকে বেরিয়ে আলট্রা মডার্ন আরবি এখন পৃথিবীর যে কোনো সাহিত্য বা সংস্কৃতিকে দাবড়ানোর ক্ষমতা অর্জনের পথে। নগিব মাহফুজ নোবেল, খজিল জিবরানের স্বাধিকার অথবা আদোনিসের বিদ্রোহী চেতনা পৃথিবীর সাহিত্যপ্রেমী মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। আরবি রক ও পপ সংগীত, আরবি বা আরব ফোক ড্যান্স এখন বিশ্বের ভ্রমণপ্রেমীদের অন্যতম আকর্ষণ; আর পিরামিড বা সব নবী-রাসুলের তীর্থস্থান, মুসলিমদের কাছে মক্কা-মদিনার মর্যাদার বিষয়টি তো আছেই। স্বাধীন ২০টি দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে আরবিকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবেও দেখা হয়। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপে দেখো গেছে, জাপানি ও চীনের শিক্ষার্থীদের পরেই আরবি ভাষাভাষী শিক্ষার্থীদের অবস্থান। আর বিশ্বরাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যকে অভিহিত করলে অত্যুক্তি হবে না। বর্তমান পৃথিবীর অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি তেল বাজারের একক কর্তৃত্ব আরবদের হাতেই। দুবাইয়ের আকাশচুম্বী অট্টালিকা তাদের ভিশনের অংশীদার। বিশ্বের অন্যতম শ্রমনির্ভর বাজার বলতে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারকেই বোঝানো হয়। বিশ্বের ২.৫ বিলিয়ন ডলারের বিশাল অর্থনীতির বাজার ক্যাপিটাল অর্থনীতির অন্যতম আকর্ষণীয় কেন্দ্র। আর মূলত আল কুরআন ও রাসুল (সা.)-এর ভাষা হিসেবে আরবি এখন পৃথিবীর আনাচে-কানাচের মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগের ভাষা। কূটনৈতিক ভাষায় বলা হয়ে থাকে, মধ্যপ্রাচ্যই পৃথিবীর মোড়ল বানায় আবার নামায়। অর্থাৎ আজকের পরাশক্তি আমেরিকা অথবা আবার শক্তির রাজ্যে ফিরে আসা রাশিয়ার শক্তি প্রদর্শনের বা অস্ত্র শান দেয়ার ক্ষেত্র তো আরব বিশ্ব। আমরা বিশ্ব অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি কিংবা রাজনীতি- যে কোনো দিক থেকেই আরবি ভাষা যে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে, তা বলতেই পারি।
আরবদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় পিছিয়ে পড়লেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আরববিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিবিড় হতে থাকে। ইরাকসহ কয়েকটি আরব দেশ প্রথম দিকেই বংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ধীরে ধীরে আশির দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার হয়ে ওঠে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র মতে, শুধু সৌদি আরবেই বাংলাদেশের ১.৯ মিলিয়ন শ্রমিক কাজ করে। আর বেসরকারি হিসাবে তা প্রায় ২.৫ মিলিয়ন। সৌদি আরবের শ্রমবাজারের ২৭ শতাংশ বাংলাদেশি শ্রমিকরা পূরণ করছেন; ইইউতে ১.১ মিলিয়ন আর কাতারে পয়েন্ট ১ মিলিয়ন। ঠিক এভাবে বাহরাইন, ওমান, কুয়েতসহ অন্যন্য আরব দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকরা সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। বাংলাদেশে বিদেশি রেমিট্যান্সের প্রায় ৬৩ শতাংশ আরবি ভাষাভাষী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আমাদের অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। এত বিশাল শ্রমবাজারের যে রেমিট্যান্স আমরা পাচ্ছি, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা ভারত বা পাকিস্তান নিয়ে যাচ্ছে তাদের দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর মধ্য দিয়ে। ইদানিং নেপালও আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। আরববিশ্বের বাজার দখলে রাখার ব্যাপারে বর্তমানে ভারত ও চীন খুবই সিরিয়াস। মধ্যপ্রাচ্যের এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে ভারতীয়দের উপস্থিতি নেই। শ্রমনির্ভর সেক্টর থেকে টেকনোলজি-নির্ভর সেক্টরে ভারতীয়দের একচেটিয়া প্রাধান্য। বাংলাদেশি ১০ জন শ্রমিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে টাকা অর্জন করেন, একজন ভারতীয় ফোরম্যান এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ অর্জন করেন। আরব বিশ্বে ভারতীয় বাজার রক্ষা, শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষায় ভারত সরকারের বিশেষ নজরদারি তাদের সফলতার অন্যতম কারণ। আর ভারতীয় কূটনীতিকদের আরবি ভাষার দক্ষতাও এক্ষেত্রে ব্যাপক কাজ করে। আমি ইংল্যান্ডে থাকাকালীন এক ভারতীয় কূটনীতিকের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতীয়দের কাছে পাকিস্তান কূটনৈতিকভাবে হেরে যায় কেন? তিনি বলেছিলেন, অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হলো ভাষা। ভারতীয় কূটনীতিকরা আরবি জানার কারণে আরবি ভাষাভাষী দেশে যেভাবে নিজেদের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারে, পাকিস্তানি কূটনীতিকরা তা পারে না। তার কথার সত্যতা আমি দিল্লির জামেয়া মিল্লিয়াতে দেখেছি। সেখানে আধুনিক আরবি ভাষা ইনস্টিটিউটে সরকারের পরিকল্পনামাফিক আরব দেশের জন্য নিয়োগকৃত কূটনীতিকদের আরবি ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। সরকারের এসব পরিকল্পনা রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনছে। কিন্তু এত বড় অর্থনৈতিক বাজার ধরে রাখা বা সমপ্রসারণে আমাদের বিশেষ কোনো প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা আছে কি? আমাদের দেশের যেসব কূটনীতিক আরব রাষ্ট্রগুলোয় পাঠানো হয়, তার কয়জন আরবি জানেন? সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে আদৌ কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। কিছুদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভাষা শিক্ষার ওপর একটি প্রকল্প চালু করেছে। এতে আরবি শিক্ষার অবস্থা খুবই করুণ। এমন সব স্থানে বা কলেজে এসব কোর্স চালু করা হয়েছে, সেখানে সাধারণ লোকের চলাফেরা খুবই কম। আবার মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের মহিলা শ্রমিকদের পাঠানোর জন্য কিছু আরবি ওয়ার্ড মুখস্থ করানোর যে সাজেশন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন টেকনিক্যাল স্কুলে পড়ানো হচ্ছে, তা রীতিমতো হাস্যকর। টেকনিক্যালের যে ইন্সট্রাক্টর এ বিষয়ে মহিলাদের পড়ান, তারা নিজেরাও আরবি জানেন না। আরবির বাংলা উচ্চারণ পড়ে আরবি পড়ান। এরূপ একটি প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপালকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা কি আরবি জানা কাউকে নিতে পারেন না? তিনি আইনি সীমাবদ্ধতার কথা বলে এড়িয়ে যান। এ তো গেল সরকারি সেক্টরে উদাসীনতার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে হাজার হাজার আলিয়া, কওমি মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের আরবি বিভাগের শিক্ষকরা আরবি ভাষাকে শুধু কুরআন-হাদিস শিক্ষার ধর্মীয় দায়িত্বের জন্যই আরবি পড়ান, না এ ভাষাকে বাংলাদেশে অন্যান্য ভাষার মতো সমৃদ্ধ সাহিত্যের ও অর্থনীতির ভাষা করতে চান এ প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে। আরবি শিক্ষার খাতে অগোছালো হলেও সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ একেবারে কম নয়। বাংলাদেশের প্রথম সারির সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগ আছে। আরবি বিভাগের শিক্ষকদের পাণ্ডিত্যের ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই, তবে তারা আরবি ভাষাকে এ দেশের সাহিত্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠার চেয়ে ইসলামিক বিষয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন বেশি। আরবি সাহিত্যের যে বৈশ্বিক মর্যাদাপূর্ণ একটি অবস্থান আছে, তা তুলে ধরতে তারা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে আরবি সাহিত্য সম্পর্কে যতটুকু আলোচনা আছে, তা ইংরেজি থেকে অনুবাদ। তবে আশার কথা, ইদানিং কিছু আরবি গবেষক তৈরি হয়েছেন, তারা মূল আরবি সাহিত্যের অনুবাদ নিয়ে কাজ করছেন। সাহিত্যসংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে আশ্বস্ত হয়েছি, তারা নিজেদের বিভাগে ‘বিজনেস অ্যারাবিক’ নামে কোর্স খোলারও চিন্তা করছেন। এসব আশার কথা। তবে মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক সুবিধা নিজেদের করায়ত্ত করার জন্য বিশ্বের সব দেশ নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই পেছনে। আরবদের বাজার আর বেশিদিন সেবাশ্রমনির্ভর থাকবে না। সেবাশ্রম থেকে তা সৃজনশীল শ্রমবাজার বা টেকনো শ্রমবাজারের দিকে যাচ্ছে। এ বাজারকে নিজেদের করায়ত্ত রাখতে ধর্মীয় ও সামাজিক অর্থনীতির সমন্বিত প্রচেষ্টা যেমন নিতে হবে, তেমনি সরকারকেও আরব দেশগুলোর শুধু শ্রমবাজারই নয় শিক্ষা, চিকিৎসা, টেকনো ও ধর্মীয় অর্থনীতির বাজার ধরার ব্যাপক পরিকল্পনা নিতে হবে। মাদরাসায় কমিউনিকেটিভ আরবি ল্যাংগুয়েজবিষয়ক শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আরবি ভাষা ও আরব বিশ্ব গবেষণার জন্য মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট খুলতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়